It is not that we have so little time but that we lose so much. … The life we receive is not short but we make it so; we are not ill provided but use what we have wastefully.
― Seneca the Younger, On the Shortness of Life
১০.
ভবিষ্যতের ‘ডট’ দেখতে চাইলে বসতে হবে ঠান্ডা মাথায়। ভুল বললাম, শুধু ঠান্ডা মাথায় নয়, সবকিছু ফেলে বসতে হবে স্থির হয়ে। নো মোবাইল ফোন, নো ইন্টারনেট, নো বূক – একদম খালি হাতে। মনে আছে ফরাসী গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকালের কথা? তার একটা কথা এখন ঘুরছে সবার মুখে মুখে। ইদানিং। এই মহাব্যস্ত ইঁদুর দৌড়ের সময়ে। “মানুষের অসুখী হবার পেছনে কারণ একটাই। ঠান্ডা মাথায় বসতে পারে না নিজের যায়গায়।” বলে কি ব্যাটা? চাকরির গত তেইশ বছর কি করলাম আমি?
১১.
চষে বেড়িয়েছি অনেক শহর। এই পৃথিবীতে। ‘ডট’এর খোঁজে। এখন বুঝতে পারি শান্তির ‘টাচবেজ’ হচ্ছে স্থির হয়ে বসা, বাসায়। একা। ফিরে আসি অ্যাডমিরাল রিচার্ড বার্ডের কথায়। উনাকে একটা মিশনে থাকতে হয়েছিল অ্যান্টার্কটিকায়। বলতে গেলে একাই। শূন্যর সত্তুর ডিগ্রী নিচের তাপমাত্রায়। পাঁচ মাসের মতো। শুনবেন উনার উপলব্ধি? পৃথিবীর অর্ধেক ‘কনফিউশন’ মানে এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি শুধুমাত্র না জানার কারণে, আসলে আমরা চলতে পারি কতো কমে! সাধারণ জীবনযাত্রায় আমাদের তেমন কিছু লাগে না বললেই চলে। তাহলে এতো ইঁদুর দৌড় কেন? সেটাতো প্রশ্ন আমারও।
১২.
মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগলে ‘টেড’এর বক্তৃতাগুলো শুনি মাঝে মধ্যে। সত্যিকারের ইন্সপায়ারিং! বিখ্যাত মানুষগুলোর সারাজীবনের জ্ঞান উগড়ে দেন মাত্র আঠারো মিনিটে। কে নেই ওখানে? পৃথিবীর “হু’জ হু”দের প্ল্যাটফর্ম ওটা। কে জানে আমিও দেবো কোন একদিন। হাসছেন? ‘গোল’ সেটিংয়ে ওটা রাখতে অসুবিধা কোথায়? দিলাম নাকি দিলাম না – সেটা হয়তোবা বলে দেবে সময়। আর কিছু না থাকলে আমাদের জন্য রয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিভি স্টেশন। ইউটিউব।
১৩.
শুনছিলাম পিকো আয়ারের কথা। এই ‘টেড’এ। ‘দ্য আর্ট অফ স্টিলনেস।’ অসাধারণ। পড়ছিলাম তার বইটাও। বক্তৃতার নামে নাম। সাবটাইটেল ‘অ্যাডভেঞ্চারস ইন গোয়িং নোহোয়ার’। নিজেকে খুঁজতে পাড়ি দিতে হবে না পাহাড় পর্বত, বসতে হবে স্থির হয়ে কোথাও, থাকতে হবে ‘অ্যাপ্রেসিয়েটিভ’ মানে ‘সপ্রশংস উপলব্ধিপূর্ণ’ চোখ। বাংলায় কঠিন করে ফেললাম নাকি আবার? সোজা কথা – দুনিয়ার ইঁদুর দৌড় থেকে নিতে হবে ‘ব্রেক’! এরপর চালু করতে হবে মনের গভীরের ‘অভিজ্ঞতাপূর্ণ’ স্লাইডশো। খুঁজে পেতে বের করতে হবে আপনার মন ভালো ছিলো কোন কোন মূহুর্তে। ডটগুলো যোগ হতে শুরু করবে ওই ‘স্থির’ হবার পর থেকে। একটু সময় নিয়ে।
১৪.
আচ্ছা, কেমন হয় প্রতিদিন থেকে বের করে নিলেন মিনিট দশেক সময়? অথবা প্রতি মাসে দিন কয়েক? আমার জানা মতে বেশ কিছু মানুষ চিনি যারা আসলেই ‘হাওয়া’ হয়ে যান কয়েক বছরের জন্য। তিন বছর পর ফোন। ছিলেন কোথায়? আফ্রিকার একটা গ্রামে। পুরোপুরি অফলাইন। নিজেকে খুঁজতে। জানতে, কি লাগে ভালো? মন আসলে চায় কি? শান্তি কোথায়? কি করলে ভালো হয়ে যায় মন? সুখী মনে হয় নিজেকে। পুরানো ‘ডট’গুলো দেখিয়েছে নতুন পথের সন্ধান। মনের গহীনে ‘ডাইভ’ দিয়েছিলেন ওই কটা বছর। এসেই ছেড়ে দিলেন ইউনিভার্সিটি’র চাকরি। আবার ডুব। দিন কয়েক আগে এলো একটা ইমেইল। থাইল্যান্ডের একটা গ্রামে স্কুলে পড়াচ্ছেন উনি। হয়তোবা ওটাই শান্তি দিয়েছে তাঁকে। কে জানে।
১৫.
তবে, আমাদের কষ্টটা অন্য যায়গায়। এতো বেশি ইনফর্মেশন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ‘ফীড’ করছে বর্তমান প্রযুক্তি, আমাদের মাথা আর পারছে না প্রসেস করতে। না পারছে ফেলে দিতে। এই বিলিয়ন বিলিয়ন ওয়েবসাইট, হাজার হাজার টিভি চ্যানেল, ইউটিউবের বিলিয়ন ভিডিও, ফোন, এসএমএস, হাজারো ফোনের কনট্যাক্টস (আমার ফোনের ‘কনট্যাক্টস’ই দেখলাম পনেরো হাজারের মতো – থ্যাংকস টু ক্যামকার্ড), ফেসবুক, লিঙ্কডইন সময় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ভুল বললাম নাকি? সেকেন্ডে বিলিয়ন কনটেন্ট আপলোড হচ্ছে ইন্টারনেটে। মানুষ তো বাড়ছে না ওই হারে। একটা বই পড়তে যেই সময় লাগে, ওর মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরো লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসের পাঁচগুণ কনটেন্ট এসে হাজির হয় আপনার আমার সামনে। এই পোস্টটা পড়ার সময় আপনি যতো তথ্য দিয়ে ‘বম্বার্ড’ হচ্ছেন, শেক্সপিয়েরের পুরো জীবনের ইনপুট অতখানি হবে নাকি সন্দেহ। কারণ, ওনার সময়ে ইমেইল আসতো না মিনিটে মিনিটে। ফোনে হতো না ‘কল ওয়েটিং’। ইন্সট্যান্ট ম্যাসেঞ্জার? হাসছেন আপনি।
১৬.
‘ইণ্টারাপশন সায়েন্স’ নিয়ে অনেক গল্প হচ্ছে ইদানিং। আপনারা বসেছেন কাজে, ওখানে ব্যাঘাত হচ্ছে কয়বার, সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা। বড় বড় গবেষণা। আবার কাজে ফিরতে পারছেন কিনা – আর ফিরতে পারলেও কতো সময় নিচ্ছে আবার মনো:সংযোগ করতে, সেখানে কেমন ক্ষতি হচ্ছে কোম্পানীগুলোর অথবা আপনার নিজের – এটার হিসেব নিয়েই তাদের গল্প। ফোন, ইমেইল, স্মার্টফোন, স্ট্যাটাস আপডেট অথবা আপনার অফিস সহকর্মী অযথাই আপনার অফিসে আসলে শুরু হয় এই সমস্যার। যারা পাইলট, সার্জন অথবা নার্সদের মতো প্রফেশনাল, তাদের কাজে ব্যাঘাত মানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। আপনি যদি একটা হাসপাতাল চালান, তবে আপনার অপারেশন থিয়েটারে কি ফোন নিয়ে যেতে দেবেন আপনি? আমি হলে দিতাম না। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের বাইরে কাজ করছেন একজন ‘ক্রু’, তার জন্য একটা ম্যাসেজ আছে জরুরী, ক্যান দ্যাট ওয়েট? তার কাজ শেষ হবার পর্যন্ত? মনো:সংযোগ বিচ্যুতি’র জন্য আধাঘণ্টার খরচ সামলাবে কে শুনি?
১৭.
ওই গবেষনার আউটপুট দেখে তো আমি থ! ‘নলেজ ওয়ার্কার’ মানে যারা আমরা মাথা বেঁচে খাই তারা প্রতি তিন মিনিটে পাল্টায় তাদের কাজ। টাস্ক সুইচিং। আর একবার ওই কাজ ব্যাহত হলে আগের যায়গায় ফিরতে গড় সময় লাগে আধা ঘন্টার মতো – এই আমাদের। অফিসে বসা লোকদের নিয়ে গবেষনার রেজাল্ট আরো মজার। গড়ে আমদের প্রতি এগারো মিনিট পর পর মনো:সংযোগের ব্যাঘাত ঘটায় এই ‘অলওয়েজ অন’ প্রযুক্তি। আর ওই এক বিচ্যুতির পর ‘পুরোনো’ মানে আসল কাজে ফিরতে গড় সময় নেয় মানুষ – মিনিট পঁচিশ। সাচ আ ওয়েস্ট অফ টাইম! আপনার ব্যবস্যায়িক প্রতিষ্ঠান চালাবেন কিভাবে? বেশিরভাগ কোম্পানীতে সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ অফিস সময়ে, কিন্তু তার স্মার্টফোনের জন্য কি নীতিমালা? ফোন বা ইমেইলের নোটিফিকেশন অ্যালার্টের ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ কেমন? আর সেটা কি শব্দ করে?
১৮.
আর যতো বেশি ইনপুট আসবে আমাদের দিকে, ততো কম সময় পাবো আসল কাজটা করতে। এই যে আমি লিখছি, তিন চার লাইন পর পর উঠতে হচ্ছে দরকারী কাজে। হয়তোবা বাজছে ফোন, কেউ বা ম্যাসেজ দিচ্ছে বিভিন্ন ইন্সট্যান্ট ম্যাসেঞ্জারে। ওয়াশিং মেশিনের ‘বীপ’ অথবা কিচেন টাইমারের রিং উপেক্ষা করতে পারছি না এই লেখার সময়ও। পিকো’র কথা একটাই – প্রযুক্তি আমাদেরকে দিয়েছে অনেককিছুই তবে ওগুলোর ‘অপটিমাইজড’ ব্যবহার মানে কতটুকু করলেই আমাদের কাজ চলে সেই বোধশক্তিটা দেয়নি খুব একটা। আগে তথ্য সংগ্রহটা ছিলো কষ্টের। আর এখন হাজারো তথ্যের মধ্যে আমাদের কোনটা ‘আসলেই’ দরকার সেটা বেছে নেবার প্রজ্ঞাটা অনেক জরুরী।
[ক্রমশ:]
Leave a comment