It [is] that courage that Africa most desperately needs.
― Barack Obama, Dreams from My Father: A Story of Race and Inheritance
০৭.
‘মাছের ঝোল লাগবে, কর্নেল?’
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম ওই মুহূর্তটাতে। ‘পীস কীপার’ রোলের পাশাপাশি ‘এবোলা’ ভাইরাস ঘাড়ের ওপর চড়ে থাকলেও ভুল শোনার মতো মানসিক অবস্থা ছিলো না ওই দিনে দুপুরে। বেশি হয়ে গেলো নাকি? ক্লান্ত? তাও না। আঠারো উনিশ ঘন্টার ইউএন ফ্লাইট তো পানিভাত। আইভোরিয়ান মেয়েটা দাড়ানো আমার সামনে। কথা বলছে – স্পষ্ট বাংলায়। একদম কুষ্টিয়া’র শুদ্ধ অ্যাকসেন্টে। হাতে গ্লাভস, সাদা টুপি, ক্যাটেরিংয়ের ড্রেস পরা। গিলে ফেললাম নিজের কথা। আগের কঙ্গো মিশনে শেখা ভাঙ্গা ফ্রেঞ্চ খানিকটা বের হলো মুখ থেকে।
‘সিল ভ্যু প্লে’। মানে, অনুগ্রহ করে দিলে ভালো আরকি। পুরোটাই অস্ফুট থাকলো মুখের ভেতর। বুঝলো কিনা জানি না।
‘আমি বাংলা জানি, ভালো বাংলা। ধন্যবাদ আপনাকে।’ সপ্রতিভ উত্তর মেয়েটার।
সুপ্রীমের সবাই এদেশীয় স্টাফ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এধরনের ‘প্রফেশনাল’ আচরণ আশা করিনি আমি।
০৮.
বিটিআরসিতে থাকার সময়েই পেলাম পোস্টিং অর্ডারটা। নিউ অ্যাসাইনমেণ্ট। কোতে দে’ভোয়া। আইভোরিয়ানদের ভাষায় না বললে দেশটার নাম ‘আইভোরি কোস্ট’। নতুন দেশ – নতুন অভিজ্ঞতা। উড়াল দিলো মনটা আগেই। দেশটার নাম নিয়ে অনেক ভাষায় অনেক ধরনের অনুবাদ হবার ফলে তাদের সরকার ‘কোতে দে’ভোয়া’ ছাড়া মানেনি কোনটাই। আমাদের অপারেশনের ইংরেজি নামটাও ওটাই। ইউনাইটেড নেশনস অপারেশন ইন কোতে দে’ভোয়া। এসেছি স্টাফ হয়ে। মাল্টি-ন্যাশন্যাল সেক্টর হেডকোয়ার্টার। থাকা খাওয়ার দ্বায়িত্ব ‘ইউএন’এর ওপর। যোগাযোগের মানুষ আমি। নতুন এলাকা। মাথাটাকে ‘ডিফ্র্যাগমেন্ট’ করে নিলাম প্রথম কয়েকদিনে। খালি হলো কিছু যায়গা। মুখ বন্ধ, চলে গেলাম ‘অবজার্ভার’ রোলে। নতুন পরিবেশে এই টেকনিক কাজ করে ভালো। থাকতে হবে নয় দশটা দেশের লোকের সাথে। এজন্য এই সেক্টরের নাম শুরু হয়েছে ‘মাল্টি-ন্যাশন্যাল’ দিয়ে। আমার তো পোয়াবারো। জানবো নতুন কালচার। বন্ধুত্বটা শুরু হলো বেনিনের আরেক কর্নেলকে দিয়ে।
০৯.
পোস্টিং অর্ডার পাবার পরের ঘটনা। সবার কথা একটাই। সব ভালো। খালি – খেতে পারবে না ‘সুপ্রীমে’। কি যে রাঁধে – ওরাই জানে ভালো। দেশ থেকে মশলা, আচার, রাইস কূকার না নিলে বিপদ। দেশ থেকে কথা হতো আগের অফিসারদের সাথে। এই ‘কোতে দে’ভোয়া’তে। মিশন এরিয়াতে ওই একটা ‘অ্যাপ’ই আমাদের লাইফলাইন। মাঝে মধ্যে স্বাতীর কানে যেতো কিছু কিছু জিনিস। চাল ডাল নেবার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করলো সে। আমার ধারনা হলো ‘সুপ্রীম’ হলো ডাইনিং হলের মতো কিছু একটা। চালাচ্ছে এদেশীয় কোন কনট্রাক্টর।
১০.
শেষমেষ ‘কোতে দে’ভোয়া’তে চলে এলাম আবিদজান হয়ে। আফ্রিকার ‘প্যারিস’ খ্যাত এই আবিদজান অনেকখানি মলিন – গৃহযুদ্ধের ফলে। দেখলাম তো আফ্রিকার অনেকগুলো দেশ। দেশ ‘ডিভাইডেড’ থাকলে যে কি হয় সেটা দেখছি নিজের চোখে। আমার কাজের জায়গাটা হচ্ছে পশ্চিম সেক্টরে। এটার ‘এরিয়া অফ রেস্পন্সিবিলিটি’ আমাদের দেশ থেকেও বড়। পাশেই লাইবেরিয়া আর গিনি। মাল্টি-ন্যাশন্যাল সেক্টর বলে অনেকগুলো দেশ কাজ করছে এখানে। আর আমাদের খাওয়া দাওয়ার দ্বায়িত্ব হচ্ছে এই সুপ্রীমের ওপর। ছোট পরিপাটি ডাইনিং হল – নিরীহ মনে হলো প্রথম দেখায়। অলিভ অয়েলে আসক্তি চলে এলো কিছুদিনেই। খাওয়া দাওয়া, সেটা না হয় আরেকদিন? ওয়ান লাইনার? আই অ্যাম লাভিং ইট!
১১.
নতুন দেশ দেখা নেশা হলেও তাদের কাজের ধারা নিয়ে লেখার অভ্যাসটা ঢুকে গেছে রক্তে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞানগুলোর ডটগুলোকে কানেক্ট করার মতো। পাঠকদের মধ্যে যে যেভাবে সেটা ব্যবহার করে! কাজে লাগলেই খুশি আমি। জানতে চাইলাম এই সুপ্রীমকে নিয়ে। যতোটা নিরীহ মনে করেছিলাম সেটা মনে হলো না আর। লোকাল স্টাফ দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য। এটা রীতিমত একটা মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ক্যাটারিং কোম্পানী। দুর্গম জায়গায় খাবার, ফুয়েল আর যা দরকার সবকিছু পাঠাতে সিদ্ধহস্ত তারা। এক লাখ খাবারের প্লেট ‘ডেলিভারী’ দেয় প্রতিদিন! পাঁচ মহাদেশ মিলে ত্রিশটা দেশে কাজ করছে গত পঞ্চাশ বছর ধরে। কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ার, গাড়ি বোমা, এক্সপ্লোসিভ আর বুলেট ফাঁকি দিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে আফগানিস্তান, সুদান, ইরাক, লাইবেরিয়া, মালী সহ আরো অনেক দেশে। রুয়াণ্ডা, সোমালিয়া আর কোতে দে’ভোয়া বাদ দেই কেন? তুখোড় কাজের ডাউনসাইডটা অনেক কষ্টের। শুধু আফগানিস্তানে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত হারিয়েছে তারা ৩১২ জন বেসামরিক কনট্রাক্টর। মন খারাপ করার মতো খবর বটে।
১২.
আজ আর নয়। এই তুখোড় কোম্পানীর গল্প নিয়ে আসবো আরেকদিন! সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের জাদুর চাবিকাঠি মনে হয় আছে তাদের কাছে! সমস্যাকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এনে ব্যবসা – এটা নিয়েই কথা হবে সামনে।
[ক্রমশ:]