কি ডিসিশন নিয়েছেন আপনারা?
ডক্টর তাকিয়ে আছেন মামুনের দিকে। দাড়িয়ে ও। ওকেই প্রশ্ন করেছেন আমাদের ডক্টর। আমার দিকে তাকিয়েছিলেন একবার। এক সেকেন্ডের মতো হবে হয়তো। ভেতর দিয়ে দেখার মতো। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সি থ্রু মি’। ঘরে মানুষ না থাকলে যেভাবে তাকায় সবাই। অথবা তাকাচ্ছেন না ইচ্ছে করেই। কোন একটা কারণে। পলক পড়ছে না মহিলার।
রাস্তা খোলা তিনটা। আমাদের সামনে। এ মুহুর্তে। খারাপ সবগুলোই। সময় দেয়া হয়েছে দশ মিনিট। দশ মিনিটের ওই সিদ্ধান্ত পাল্টে দেবে আমাদেরকে। সারাজীবনের জন্য। এতোই কমপ্লেক্স ব্যাপারটা – মনে হচ্ছে, ডক্টরের সারাজীবনের পড়াশোনার মুখোমুখি দাড়িয়ে আমরা।
শেষ হয়ে গেছে ওই মিনিট দশ। কিছুক্ষণ আগেই।
***
দশ দিন আগের ঘটনা। প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছিলো আমার। হঠাৎ করেই।
‘ঘাবড়াবেন না তো এতো!’ বলেছিলেন আরেক ডক্টর। ‘প্রেগন্যান্ট মহিলাদের কমন সিম্পটম জিনিসটা।’ কয়েকটা পরীক্ষা দিলেন বরং। আমাকে।
এতো ঘাবড়ালে মানুষ করবেন কি বাচ্চাদের? মনে হলো, সাহস দিলেন মামুনকে। ওই ডক্টর। আসলেই ঘাবড়ে গিয়েছিলো মামুন। এতো বিচলিত হতে দেখিনি আগে ওকে।
আলট্রাসাউন্ডের রেজাল্ট পারফেক্ট। হার্ট মনিটরেও এলো সবকিছু। ভালো। ভালো সবই। তবে ভালো ছিলো না কিছু একটা।
দশ ঘন্টা আগে ধরা পড়ল সমস্যাটা। ঠিকমতো সাপ্লাই পাচ্ছে না। বাচ্চা দুটো। আমার প্ল্যাসেন্টা থেকে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ওজন বেড়েছে আমার। বিশেষ করে তলপেটের ওজন। ফুলেছেও বেশ। ব্যথা অনেক বাড়লেও বলিনি মামুনকে। কাঁদছিলাম মাঝে মধ্যেই। একা একা। নিতে পারছিলাম না আর। ধরে ফেললো মামুন এক রাতে।
কি করবো আমরা? জিগ্গেস করেছিলো মামুন। ‘আপনি আমার মেয়ে হলে’, ডাক্তার তাকালেন আমার দিকে। এবার ভালোভাবে। দম নিলেন কয়েক সেকেন্ড। ‘বলতাম টার্মিনেট করতে।’
দশ মিনিট আগের ঘটনা। আমাদের নতুন স্পেশালিস্ট মহিলা বুঝিয়েছিলেন ব্যাপারটা। এক বাবুমনি পাচ্ছে যা, অন্যজন পাচ্ছে না সেটাও। আমার নাড়ি থেকে। ব্যাপারটা এমন – একজন বাঁচলেও পারবে না পরের বাবু। স্টেজ তিন চলছে। চার হলে শেষ সব। মারা যাবে দুজনই।
দুটো জিনিস হতে পারে আমাদের সামনে। ইশারায় হাত দিয়ে দেখালেন ডক্টর। ‘অ্যাবর্ট করতে পারি আমরা। একজনকে।’ চোখ সরিয়ে নিলেন আমার থেকে। উপচে এলো আমার কান্না। ‘আশা করছি’ দম নিলেন মহিলা, ‘এই সিলেক্টিভ টার্মিনেশনে নরমাল লাইফ পাবার সম্ভাবনা আছে একটা বাচ্চার।’ আটকাতে পারলাম না আর। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। ধরে রইলো মামুন আমাকে। শক্ত করে।
‘শেষ চেষ্টা হিসেবে সার্জারির একটা অপশন আছে আমাদের। রিপেয়ার করার চেষ্টা করতে পারি আপনার প্ল্যাসেন্টাকে। যদি বাঁচে দুজন ..’ থামলেন ডক্টর। ‘তবে, সেটা ঠিক না হলে বিপদের সম্ভাবনা বেশি। বিপদে পড়বে সবাই।’ তাকালেন আমার দিকে। বুঝলাম আমি। স্ট্রেস দিলেন শেষে। ‘মা সহ’।
মামুন তাকালো আমার দিকে। বোঝা গেল রাজি না সে। সার্জারিতে। ডক্টর জানালেন, আমরা সার্জারি চাইলে করতে হবে তাড়াতাড়ি। আজই।
‘কথা বলুন আপনারা’ উনি বললেন, ‘দশ মিনিট পর আসছি আমি। জানাবেন কি চাচ্ছেন আপনারা?’ বেরিয়ে গেলেন ডক্টর।
বাবু দুটোই আমার ভেতর। দুজনের নড়াচড়ার রিদম বুঝতে পারি আমি। ডক্টর দুটো রাস্তার কথা বললেও আমি দেখছি না কিছু। বাচ্চাদের ছবি ভাসছে এখনো। সামনের স্ক্রিনে। সেগুলোর প্রিন্টআউটও আমাদের হাতে। ১৮ সপ্তাহেই চলে এসেছে তাদের চেহারার অবয়ব। এক বাবুর নাক দেখা যাচ্ছে। ভালোভাবে। হাতের শেপও দেখা যাচ্ছে চিবুকের কাছে। মনে হচ্ছে ভাবছে কিছু। বাবুটা। শেপগুলো মুখস্ত আমার। দেখছি তো কয়েকদিন ধরে। গেঁথে গেছে মাথায়।
কাঁদছে মামুন। ধরে আছে আমাকে। শক্ত করে। ও বুঝে গেছে এর মধ্যেই। মানুষকে বুঝতে পারে ও দেখেই। ব্যতিক্রম হয়নি এখানে। ও বুঝতে পারছে কি ঘুরছে মাথায় আমার। মানা করছে আমাকে। বার বার।
জেদি নই আমি। সবাই জানে সেটা। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ আমাদের। বিয়ের আগেই বলেছিলো ওর সমস্যার কথা। চোখের। আমার বাবা মাকে। সবাই সরে গেলেও সরিনি আমি।
হাত ছাড়ছে না মামুন। চোখ মুছলো ও। তাকালো আমার দিকে।
আরেক হাত বাড়ালাম ওর দিকে। ধরতে ওকে। দুহাতে। এতো নিশ্চিত মনে হয়নি আমার কখনো। এই নিজেকে।
বললাম, ‘খবর দাও ডক্টরকে। তৈরি আমি।’