If the only tool you have is a hammer, you tend to see every problem as a nail.
― Abraham Maslow
৩৯৫.
শেষ হয়ে আসছে সময় আমার। বর্তমান এসাইনমেন্টে। চমত্কার কেটেছে এই সাত সাতটি বছর। একটা মানুষ পৃথিবীতে বাঁচে পঁচিশ হাজার দিনের কাছাকাছি। আর আমার আড়াই হাজার দিন হলো বলে – এখানে। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের একটা বই পড়েছিলাম এখানে আসার পর পরই। নাম ‘আউটলাইয়ার্স’। শ-খানেক সাফল্যমন্ডিত মানুষদের নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন। কিছুটা প্যাটার্ন এনালাইসিস। ওখান থেকে বেরুলো ‘দশ হাজার ঘন্টা’র একটা থাম্বরুল। কেউ কোনো বিষয় নিয়ে দশ হাজার ঘন্টা কাজ করলে তার সাফল্য অনিবার্য। মানে ও বিষয়ে জ্ঞানী বলা যেতে পারে তাঁকে। বিল গেটস, স্টিভ জবস থেকে শুরু করে সবাই তাদের কোম্পানি খোলার আগেই দশ হাজার ঘন্টা দিয়েছেন – নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে। বিশ্বাসযোগ্য রুল, ডক্টরাল ডিগ্রীর জন্যও দশ হাজার ঘন্টার নিয়ম খাটে। দুটো দশ হাজার ঘন্টা’র সাইকেল চালিয়েছি আমি – এখানে। শুধুমাত্র অফিস সময়েই! বিশাল সময়।
৩৯৬.
কেমন কেটেছে আমার? এক কথায় মাইন্ড ব্লোয়িং! জ্ঞানের সাগরে সাঁতার কেটেছি প্রতিদিন! কথা হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের সাথে। হৃদয়ে ছিলো স্টিভ জবসের মন্ত্রটা। স্টে হাংরি, স্টে ফুলিশ! বোকা ছিলাম আগে থেকেই, শেখার আগ্রহটা বাড়িয়েছি, এই যা! পুরো বিশ্বের জ্ঞান যেন উপচে পড়ছে এখানে। টেলিযোগাযোগ জ্ঞান। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন সকালে অফিসে ঢোকার সময় মনে হয়েছে একটা কথা। কে জানে, আজই হয়তোবা শেষ দিন। এমন কি করা যায় যাতে মনে থাকে দিনটার কথা? মন বললো ‘কিছু ভালো কাজ করো আগের দিন থেকে’। অল্প অল্প করে প্রতিদিন।
৩৯৭.
কিভাবে সম্ভব? ‘সাহায্য করো মানুষকে। একজন করে প্রতিদিন। যেদিন তুমি যাবে পড়ে, ওরাই তুলবে টেনে’ আন্দ্রিয়া’র উত্তর। ‘দশটা নিঃস্বার্থ হাত পাওয়া কম কথা নয় তোমার বিপদের সময়ে।’ মজার কথা, সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার সহকর্মীরা। শুরু হলো বেবি ওয়াকিং। তিন চেয়ারম্যান রাখলেন আগলে। বাবার মতো। সব বিপদ থেকে।
৩৯৮.
কোথায় যেন পড়েছিলাম সমস্যার সমাধানে বের হয়ে আসতে হবে ওর ভেতর থেকে। মানে বাইরে থেকে দেখতে হবে সমস্যাটাকে। তাহলেই ওর ফাটল মানে ‘ফল্টলাইন’ পড়বে চোখে। সমস্যাটা বুঝতে পারলেই তো সমাধান ‘পিস অফ কেক’! আইডিয়াটা মন্দ নয়। দুটো ইনপুট হাতে।
ক. সাহায্য করো মানুষকে। একজন করে প্রতিদিন।
খ. বাইরে থেকে দেখতে হবে সমস্যাটাকে। তৈরী করো বাইরের যোগসূত্র।
আউটপুট নিয়ে চিন্তা করলাম মাসখানেক। সাহায্যপ্রার্থী একজন করে মানুষ খুঁজে পাওয়া সমস্যা নয়, কিন্তু আমার কাজের আউটকামের ফলাফল যাচাই করতে লাগবে বাইরের ইনপুট। অফিসে আমার কাজই সাহায্য করা বিজনেসগুলোকে, যাতে আরো বাড়তে পারে ওরা। তারাই তৈরী করছেন কর্মক্ষেত্র। যুক্ত করছেন মানুষ আর ব্যবস্যাকে – একে অপরের সাথে। ফলে বাড়ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। আবার, কি ধরনের প্রতারণার সমস্যায় পড়ছেন সাধারণ গ্রাহকরা সেটাও জানতে চাইলাম মনে মনে। উপায় কি? সাহস করেই মোবাইল নম্বরটা দিলাম ওয়েবসাইটে। পাল্টে যেতে থাকলাম সেদিনের পর থেকে। কর্মক্ষেত্রকে চিনতে থাকলাম নতুনভাবে। বাইরে থেকে। নিউট্রাল গ্রাউন্ড বলে কথা। কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া। ২৪/৭ কলসেন্টারের মতো কিছুটা। হাজারো ফীডব্যাক। কাজের প্রায়োরিটি পাল্টাতে থাকলো ধীরে ধীরে। নতুন একটা ইমেইল এড্রেসও খোলা হলো এব্যাপারে।
৩৯৯.
এই এসাইনমেন্টে এসে বুঝতে চাইলাম কাজের কোন কোন অংশগুলো বড় ‘টাইম ওয়েস্টার’ মানে সময়খাদক। ইন্ডাস্ট্রির প্রথম ফিডব্যাক, আপনার কাজের পদ্ধতিটার ডিটেলস তো লেখা নেই কোথাও। আর থাকলেও আছে কিছু মানুষের মুখে মুখে। লিখে টানিয়ে দিন ওয়েবসাইটে, ফোনকল আর অফিসে মানুষের আনাগোনা কমে যাবে অর্ধ্যেক! সার্ভিস প্রোভাইডাররা কোনটা পারবেন করতে আর কোনটা নয়, সেটা জানার জন্য হাজারো প্রশ্ন থাকতো তাদের পক্ষ থেকে। কোন সার্ভিসের দাম কতো আর তার শর্তগুলো জানার উপায় ছিলো না কোনো। পদ্ধতিগুলো লেখা থাকলে সার্ভিস প্রোভাইডার থেকে শুরু করে রেগুলেটর আর সাধারণ গ্রাহক – সবাই খুশি। ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো প্রতিদিন বলতে হবে না সবাইকে। সময়খাদকের কাজ কমতে থাকলো।
৪০০.
সামরিক বাহিনীর সব কিছুই ‘প্রসেস ড্রিভেন’, আর সেই প্রসেসগুলো লেখা আছে কোথাও। অস্ত্র কিভাবে খুলতে আর জুড়তে হবে সেটা থেকে শুরু করে বিশাল অপারেশন চালানোর পদ্ধতি সব কিছুই আছে ‘স্ট্যান্ডিং অপারেটিং প্রোসিডিউরে’। এর বহুল প্রচলিত শব্দটা হচ্ছে ‘এসওপি’। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘এসওপি’ দেখো। রাস্তার কোন দিক দিয়ে হাটবো, ওটাও আছে ‘এসওপি’তে! মানুষের জীবন নিয়ে যাদের কাজ, সিদ্ধান্ত আর কাজের পদ্ধতির খুঁটিনাটি জানা থাকতে হবে আগে থেকেই। ফাস্ট পেসড যুদ্ধে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয় সেকেন্ডে!
৪০১.
উনিশশো নব্বইয়ের দিকে ‘ইউনিক্স’ অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। নিউজগ্রুপে যাই প্রশ্ন করি – উত্তর আসে, ‘আরটিএফএম’ মানে রিড দ্যা *কিং ম্যানুয়াল! ওই ম্যানুয়াল পড়তে পড়তে পড়লাম ভালবাসায়। প্রায় সব কিছুর উত্তর দেয়া আছে ওখানে। শিখে ফেললাম ম্যানুয়াল পড়া। লিখতেও শুরু করে দিলাম আমার মতো করে। অর্গানাইজেশনের জন্য। মনে হলো পৃথিবীটা আমার হাতে। উনিশশো আশি সালের দিকে হাতে এসেছিলো কমোডরের একটা ১২৮ কিলোবাইটের পিসি। সত্যিকারের গানের ক্যাসেট হচ্ছে ওর স্টোরেজ। চালাতে না পেরে ওর ম্যানুয়ালগুলো নিয়ে বসলাম সপ্তাহ খানেক। চালাতে পারবো না মানে? ওই জ্ঞান দিয়েই চালাচ্ছি আজ ইউনিক্স, লিনাক্স আর অ্যান্ড্রয়েডের মতো কাস্টমাইজড অপারেটিং সিস্টেম। এমবেডেড অপারেটিং সিস্টেম চলছে বাসায়। লিখতে শিখিয়েছি সহকর্মীদের। তবে কাজের পদ্ধতি নিয়ে থেকে নিজে লেখা শুরু করলেও এখন আমার সহকর্মীরা আমার থেকেও তুখোড়।
৪০২.
যাই লিখি সেটার প্রথম খসড়াতে ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। আর ওটাকে একা ঠিক করতে গেলে চলে যাবে মাসের পর মাস। ওগুলো দেখালাম কিছু কিছু ইন্ডাস্ট্রি স্টেকহোল্ডারদের। ফীডব্যাক আসলো কনসালটেন্ট বন্ধু ‘মিরিয়াম’ থেকে। সুইডিশ রেগুলেটরের হয়ে কাজ করেছেন অনেকদিন। ‘পাবলিক কনসালটেশন’ মানে গণশুনানি করো ওয়েবসাইটে। বলে কি মেয়েটা? পুরোপুরি দাড়ায়নি কিন্তু খসড়াটা, স্বগোক্তির মতো শোনালো কথাটা। বুঝলো সে, মনে হলো। ‘‘পাবলিক কনসালটেশন’ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ জিনিস।’ মিরিয়াম বললো। ‘কি চাও সেটা লেখো কয়েক লাইনে। বেশি বড় না। ধরে নাও ব্যাপারটার কিছুই জানো না এমুহুর্তে। ব্যাপারটার সম্মন্ধেই জানতে চাও সবার কাছ থেকে। তুমি তিন লাইন লিখলে মানুষ লিখবে তিরিশ লাইন। আর ইন্ডাস্ট্রি লিখে দেবে তিনশো লাইন। প্রয়োজনীয় জিনিসটা রেখে বাকিটা ফেলে দিয়ে আলাপ করো সামনাসামনি। কয়েকবার। সবার ইনপুটগুলো পড়লেই একটা ‘পার্সপেক্টিভ’ পাবে। ভুল হবে না তোমার। সাহস করে চেয়েই দেখো না একবার। নিজের ইমেইল এড্রেস দিতে ভুল করো না কিন্তু!’
৪০৩.
আলাদিনের চেরাগ পেলাম হাতে। অনেক অনেক পাবলিক কনসালটেশন করেছি এপর্যন্ত। যুক্তি আছে সবারই। ‘হ্যা’ দলের যুক্তি পড়তে গিয়ে যতটা ‘কনভিন্স’ হলাম ততটাই ‘ক্রিটিকাল এনালাইসিসে’ পড়তে হলো ‘না’ দলের যুক্তিতে। সবার সাথে আলাপ করলেই বোঝা যায় কি চাচ্ছি আমরা। অসাধারণ একটা টুল। একবার সাত সাতটা পাবলিক কনসালটেশন লেগেছিলো একটা ব্যাপারকে ঠিক করতে গিয়ে। এখনো চলছে অনেকগুলো। ভারসাম্য রাখাটাই হচ্ছে অর্গানাইজেশনের মুন্সিয়ানা। বিশ্বের বড় বড় সরকারী সিদ্ধান্ত আর তার ডকুমেন্ট তৈরী কাজের অনেকাংশ ছেড়ে দিয়েছে জনগনের ওপর। ‘সরকারী শাসনব্যবস্থা ২.০’ বলে নাম দিয়েছে টেকিরা। নীতিনির্ধারণী নীতিমালার খসড়া তৈরীর দ্বায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছে ‘ক্রাউডসৌর্সিং’য়ের ওপর। জনগণ আর সম্পর্কিত স্টেকহোল্ডাররাই লিখে দেয় বিশাল বিশাল ডকুমেন্ট। দেশটা তো জনগণেরই। ধারনাটা যে দেশগুলো নিচ্ছে তারাই উঠছে ওপরে। তাড়াতাড়ি।
৪০৪.
পাশাপাশি প্রাইস-ওয়াটারহাউস-কুপার্স, অ্যাকসেন্চার, ওভাম, এনালাইসিস ম্যাসনের মতো অনেকগুলো বড় বড় ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং ফার্ম থেকে শুরু করে গুগল আর ফেইসবুকের মতো ‘গেমচেঞ্জার’ কোম্পানিগুলোর সাথে পরিচয় হতে থাকলো। ‘ওয়ার্ড অফ মাউথ’ কি না জানি না – অনেকেই যোগাযোগ শুরু করলো বিভিন্ন কাজে। পরিচিত হতে সময় লাগলো না। চেয়েই নিলাম ব্ল্যাকবেরি, অফিস থেকে। ২৪/৭ ইমেইল সার্ভিস! অফিসের আইটি ডিপার্টমেন্টটাও দেয়া হলো আমার সাথে। বসিয়ে ফেললাম এক্সচেঞ্জ সার্ভার, প্রথম ধাক্কায়! পুশ মেইলের ভালবাসায় পড়লে যা হয় আর কি! ইমেইল করি এসএমএসের মতো। মেইলের উত্তর ঘন্টায় ঘন্টায়। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ টেলিকমিউনিকেশন অর্গানাইজেশন, আইক্যান, আইসক, এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি, ওয়ার্ল্ডব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য রেগুলেটরদের সাথে কথা বলতে বলতেই বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে ধারণা পেতে শুরু করলাম।
৪০৫.
বিশ্ববাজারে আমাদের অবস্থান কোথায়? পাল্টাতে থাকলো চিন্তাধারণা। ‘থিঙ্ক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল’ ধারণাটা গেড়ে বসতে শুরু করলো মনের মধ্যে। গ্লোবাল স্কেলে আমাদের অবস্থান নিয়ে জোর ‘ফাইট’ দেয়া শুরু করলাম সহকর্মীদের সহায়তায়। সুফল এলো কিছু জায়গায়। সবার কথা একটাই, ইট’স অল এবাউট ‘ভিজিবিলিটি’! আমাদের দেশকে চিনবে কি দিয়ে? উত্তর সোজা, সংখ্যা দিয়ে। স্ট্যাটিসটিকাল ইনডিকেটরগুলো পাল্টে দিচ্ছে দেশগুলোকে, দিনের পর দিন। ভুল করার অবকাশ নেই নীতিনির্ধারকদের। একটা ভুল, সেটাকে শুধরাতেই লাগবে অনেকটা বছর!
৪০৬.
দেশের অর্থনীতিতে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই)’ কতো বড় জিনিস সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আফ্রিকাতে যেয়ে। হাজারো কোটি ডলারের ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ তৈরী করে বসে আছে দেশগুলো। ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ মানে শুধুমাত্র রাস্তাঘাট নয়, ব্যবস্যাবান্ধব নীতিমালাও কিন্তু। মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘বিল্ড ইট, দে উইল কাম! বানাও ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ব্যবস্যাবান্ধব নীতিমালা – ওরা আসবেই! ওরা আসা মানে হাজার কোটি ডলার ঢুকছে দেশে, কর্মযজ্ঞ হবে শুরু, বাড়বে জিডিপি! বাড়বে শিক্ষা, বাড়বে নাগরিক সুবিধা। ‘এফডিআই’ আকর্ষণ করে আনা যতটা কষ্টের – ধরে রাখা আরো কষ্টের।
৪০৭.
‘এফডিআই’ আনার থেকে ধরে রাখা কষ্টের কেন? কফি মগে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে দাড়ালো কেভিন। ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। ও কাজ করছে একটা বড় ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং ফার্মে। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ তাদের সরকারী আর বেসরকারি কাজের সব ‘প্রসেস’ তৈরী করিয়ে নেয় এদের দিয়ে। কাজ মানুষ নির্ভর নয়। আমার মতো মানুষ অফিস পাল্টে অন্য জায়গায় গেলেও ‘প্রসেস’ মানে কাজের ‘ডিরেক্টিভ’ থাকবে অপরিবর্তিত। কথায় আছে না – হাকিম নড়লেও নড়বে না হুকুম। ভ্রু কুঁচকানোটা কমতে থাকলো মনে হচ্ছে।
৪০৮.
ডিনারের ইনভিটেশনটা ছিলো আমার। মানে আমিই খাওয়াচ্ছি ওকে। সেজন্য কি না জানি না, স্মিত হাসি হাসলো সে। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল দেখালো বরং। এফডিআই আনা আর ধরে রাখার জন্য লাগবে কয়েকটা জিনিস, ১. ইনফ্রাস্ট্রাকচার মানে বিদ্যুত, রাস্তাঘাট আর ব্যবস্যাবান্ধব নীতিমালা, ২. তবে হঠাত্ করে ট্যাক্স রেজীম পাল্টানোটা বিপদজনক যে কোনো দেশের জন্য, ৩. রেগুলেটরি নিশ্চয়তা মানে পাল্টাবে না নীতিমালা একটা সময়ের মধ্যে, ৪. টাকা দেশের ভেতরে আর বাইরে যাবার সহজ নীতিমালা মানে ‘ক্যাপিটাল কন্ট্রোল’ পলিসি আর ‘কালচারাল ডিফারেন্স’ মানে সংস্কৃতিতে মিলতে হবে দেশগুলোকে।
৪০৯.
কেভিনের মতো শত শত বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মাথা খুলেছে কিছুটা। আমি এখন ওদের জুতো পরতে শিখেছি ভালো মতোই। মানে বাইরের একটা ইনভেস্টর আমাদের দেশকে অন্যদেশগুলোর ওপর কেন বেছে নেবে সেটা আর রকেট সাইন্স নয়। অন্ততঃ আমার কাছে নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক তর্ক বিতর্ক দেখতে হয় মাঝে মধ্যে। কিছু হলেই একদল আরেকদলকে দেশ বিক্রি করার অভিযোগ করছে। অথচ পৃথিবীব্যাপী দেশগুলো নিজেদেরকে কিভাবে একে অন্যের কাছে বেচবে সেটা নিয়ে চলছে হাজারো স্ট্রাটেজি। দেশ বেঁচতে পারাটা অন্য ধরনের স্কিল।
৪১০.
আফ্রিকার দেশগুলো কিভাবে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সগুলোতে নিজেদের বিক্রি করছে সেটা দেখলে চোখ উঠবে কপালে। একেকটা দেশের ব্র্যান্ডিং দেখলে মনে হয় একেকটা ব্যবস্যার স্বর্গ। কথায় চিড়ে ভেঁজে না। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে বড় বক্তিমা দিলেন ওই দেশে ‘ইনভেস্ট’ করার জন্য – তাতেই টাকা নিয়ে ছুটবে না ইনভেস্টররা। সবার কষ্টার্জিত টাকা। এটা নিয়ে হয় মিলিয়ন ডলারের গবেষণা। যারা গবেষণা করেন তারা অনেকেই কথা বলেছেন আমার সাথে। প্রশ্নের ধরন দেখেই মাথা গেছে ঘুরে। কোথায় আছি আমরা? এতো খুঁটিনাটি জানতে হয় দেশকে বেঁচতে? কতটা ‘প্যাশনেট’ হলে এদেরকে আনা যায় একটা দেশে?
৪১১.
উদাহরন দেবো একটা? ধরে নিন আমি বাইরের একজন ইনভেস্টর। ঢাকায় আসার আগে তিনটা রিপোর্ট নিয়ে বসবো সবার আগে। কনসালটিং ফার্ম নিয়োগ দেবার আগ মুহুর্তে। বলতে পারেন এগুলোই এফডিআই’র টুলকিট। আমার ধারণা, অনেকেই বলবেন এটা।
ডুইং বিজনেস, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট, কোন দেশ কতটা ব্যবস্যাবান্ধব তার রাঙ্কিং দেয়া আছে এখানে
ডুইং বিজনেস, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ভয়াবহ রিপোর্ট একটা। কোন দেশের কোন শহর কতটা ব্যবস্যাবান্ধব সেটার লিস্টি করে এই রিপোর্টটা। একশো নব্বইটার মতো দেশের মধ্যে ছোট থেকে মাঝারি ব্যবস্যার লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে কে কতো স্বল্প সময়ে ব্যবস্যা শুরু করতে পারে সেটার একটা বিশাল রাঙ্কিং। বিদ্যুতের লাইন, কন্ট্রাক্ট এগ্রিমেন্ট অথবা ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিবন্ধনের জন্য কোন দেশে কতদিন লাগে তার সব গল্প দেয়া আছে ওখানে। ‘রাজুক’ থেকে অনুমতি পাবার দিনক্ষণ আর সম্পত্তির হস্তান্তরের সময়কালও এই রিপোর্টকে ‘ইমপ্যাক্টেড’ করেছে। দেশগুলোর সীমান্তের এপার থেকে ওপারে ব্যবস্যা শুরু করা নিয়েও আছে রাঙ্কিং! এই রাঙ্কিংগুলো নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে চলছে অলিখিত যুদ্ধ। কোন দেশের নীতিমালা কতটা ব্যবস্যাবান্ধব সেটার বেঞ্চমার্কিং নিয়ে একেক দেশ ফেলে দিচ্ছে অন্যদেরকে – বছরের মাথায়। অনেকটা নিঃশব্দেই। আর এটাই স্নায়ুযুদ্ধ।
৪১২.
ডুইং বিজনেস রিপোর্টটা মূলতঃ কাজ করেছে দেশীয় ব্যবস্যা নিয়ে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশীয় ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ না করতে পারলে পুরো অর্থনীতিতে নামে ধ্বস। আর একারণেই ‘এসএমই’ মানে স্মল এন্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলোকে ওঠানোর জন্য মুখিয়ে আছে দেশগুলো। ‘টাকা লাগলে নাও, নীতিমালাতে কোথায় ছাড় দিতে হবে বল আমাদের, করে দিচ্ছি এখুনি’ বলছেন দেশগুলোর নীতিনির্ধারকরা! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল অর্থনৈতিক মন্দায় দাড়িয়েছিল এই ‘এসএমই’ অংশ। জার্মানি এখনো দাড়িয়ে আছে এই ‘এসএমই’ হাই-প্রিসিশন ইন্ডাস্ট্রির ওপর। দেশীয় কোম্পানিগুলোর সমস্যা বুঝতে হবে আগে। বাইরের ইনভেস্টররা আগেই জানতে চান দেশীয় ব্যবস্যার ধরন। নিজেদের পরিচিত মানুষের মধ্যে যদি ব্যবস্যা না করতে পারে তাহলে অজানা মানুষ এসে কি করবে এখানে? শিক্ষিত গ্রাজুয়েটদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই বেকার, চাকরির পেছনে না দৌড়ে কোম্পানি খুলতে প্রণোদনা দিতে হবে নীতিনির্ধারকদের। আর সেকাজটি করতে চেষ্টা করেছি এই ডেস্কে বসে। খোল কোম্পানি আর নিয়ে যাও সার্ভিস এপ্রুভাল! সবকিছুর যে সনদ লাগবে তাও নয়, উদ্ভাবনা আগে!
৪১৩.
কি নেই এই রিপোর্টটাতে? পুরো ‘বিনিয়োগ আবহাওয়া’ দেয়া আছে ওর মধ্যে। শীর্ষস্থান ধরে আছে কে বলুনতো? এ বছরে? ঠিক বলেছেন, সিঙ্গাপুর। যাদের খাবার পানিটাও কিনে খেতে হয় পাশের দেশ থেকে তাদের নীতিমালা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মতো বিলাসিতা সাঁজে না। সাগর সেঁচে যারা প্রতিনিয়ত মাথা গোজার জমি উদ্ধার করে তাদের আর যাই হোক ‘দক্ষ’ না হয়ে উপায় নেই। যাই কাজ করি না কেন অফিসে – আমাদের রাঙ্কিংটা ভাসে চোখের সামনে। সবসময়। সেই দুহাজার সাত থেকেই। বিশ্বাস হচ্ছে না? চেখে দেখুন নিজেই এখানে। রিপোর্টটা লাগবে? দুহাজার চৌদ্দেরটা? সময় আর সুযোগ পেলে রিপোর্ট বানাতাম একটা, আমাদের টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোর জন্য। তৈরী করতে গিয়ে বুঝতাম কোথায় কোথায় কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এখনো।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভ রিপোর্ট’টা দেশগুলো কে কতটুকু প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আছে সেটা দেখায়
৪১৪.
দ্বিতীয় রিপোর্টটা হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের। ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভ রিপোর্ট’টা নামেই বলে দেয় দেশগুলো কে কতটুকু প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আছে। অন্যদের থেকে। ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস’টা নির্ভর করছে তিনটা জিনিসের ওপর। প্রথমটা হচ্ছে একটা দেশে যেটা না থাকলেই নয় সেরকম কিছু দরকারী স্তম্ভ। পরেরটা নির্ভর করছে দক্ষতার ওপর। উদ্ভাবনা আর সফিস্টিকেশন জিনিসগুলো আসছে শেষে। দরকারী অংশে এসেছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকমতো কাজ করার ব্যাপারে। সেভাবে আমাদের অফিসটাও একটা প্রতিষ্ঠান।
৪১৫.
ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বড় আকারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে চলমান রাখার ইনডেক্সও আছে এরমধ্যে। জনগনের চিকিত্সাসেবা আর প্রাথমিক শিক্ষার রাঙ্কিংয়ে দেশগুলো কতটুকু প্রতিযোগিতায় আসছে সেটাও এই রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত। দক্ষতার সাব-ইনডেক্সে উচ্চতর শিক্ষা, পণ্য ও শ্রম বাজার কতটুকু প্রতিযোগিতাপূর্ণ আর সেটার বাজার কতো বড় তার একটা পরিমাপ করা হয় এখানে। পুঁজিবাজারে টাকার ফ্লো আর কতটুকু টেকনোলজিক্যাল রেডিনেস আছে দেশটার তা এসেছে রাঙ্কিংয়ে। বিজনেস ‘সফিস্টিকেশন’ আর উদ্ভাবনা ওই দেশে কতটুকু কাজে লাগাতে পারবে সেটা দেখে তো ইনভেস্টর আসবে, তাইনা? রিপোর্টটা দরকার? পুরোটা?
৪১৬.
তিন নম্বর রিপোর্টটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। বুকের ভেতরে রাখার মতো রিপোর্ট। ‘স্বাধীনতা’র ইনডেক্স। কতোটা স্বাধীন আপনি? আপনার নিজের দেশে? স্বাধীন দেশে? এটা নিয়ে আসবো সামনে।
বিনিয়োগকারীরা টাকা ঢালার আগে দেশগুলোর ওই সংখ্যাগুলোর দিকে তাকান বার বার। আমিও তাকাতাম। এখন বুঝি কেন কমছে এফডিআই ফ্লো। একটা প্রসাশনিক অনুমোদন পেতে লাগে কতদিন – ওই দেশটাতে, তার জন্য খরচ কতো, অনলাইনে, নাকি ঘুরতে হবে টেবিলে টেবিলে এর সবকিছুর আউটকাম চলে এসেছে এই রিপোর্টগুলোতে। ব্যবস্যা শুরু করতে কতগুলো প্রসিডিউরের মধ্যে যেতে হবে সেটা কমাতে চেস্টা করেছি আমার প্রান্ত থেকে। আমার টেবিল থেকে। স্বচ্ছতা বাড়ানো চেষ্টা করেছি মুখে কিছু না রেখে লিখে রেখে যেতে। মানুষের মাথায় আর লেখা ‘ডিরেক্টিভে’র পার্থক্য বিস্তর। মাথায় থাকলে পাল্টে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর সেটার ‘কমপ্লায়েন্স কস্ট’ অনেক বেশি। চেষ্টা করেছি ‘প্রসেস’ তৈরী করে দিতে, চমত্কার কাজ হয়েছেও অনেক ক্ষেত্রে। সহজাত কারণে মানুষ আর অটোমেশন একসাথে না গেলেও এটাকে সমার্থক শব্দ করতে সাহায্য চেয়েছি সহকর্মীদের। হবে সেটাও।
নতুন প্রজন্ম না ওরা? অগাধ বিশ্বাস আছে ওদের ওপরে।
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ।
[ক্রমশঃ]
Read Full Post »